টুকরো ছবি
১
“তাহলে প্রিয়গোপাল বিষয়ী থেকেই কিনছিস তো বেনারসীটা?”
সেক্টর ফাইভ লাগোয়া সিসিডী তে বসে দুই বান্ধবির কথোপকথন তা অনেকক্ষন ধরে
শুনছিল অনিন্দ্য। পথচলতি পিএনপিসি, আসছে অগ্রহায়ণে বিয়ের শপিং, সোনার বাজার দরের
ওঠানামা, কোন বান্ধবী সবছেয়ে জম্পেশ বর পাকড়াও করেছে থেকে কোথায় হানিমুনে যাওয়া
যায়- সবই সেই আলচোনার অংশ। কাছাকাছি কোন বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী
দুজনেই সেটা ট্যাশপনা দেখলেই বোঝা জায়। সদ্য চাকুরিতে ঢুকেছে বোধহয়, এখনও দাস্বত্বের
রঙিন স্বপ্নের ঘোর লেগে আছে কথাবার্তায় বোঝা যায়।
অনেক ক্ষন ধরেই অদের কথায় আড়ি পাতছিল অনিন্দ্য। মাঝে মাঝে করে সে এরকম।
কিছুটা একঘেয়েমি কাটানোর জন্য শুরু করেছিল অভ্যেস টা।।এখন অনেক টাই নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম প্রথম যখন বর্ধমানের বাড়ি ছেড়া কলকাতায় পড়তে এল, যাদবপুরের কাছেই একটা
মেসবাড়ি ভাড়া করে থাকতো তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে। তখন এত একঘেয়েমি ছিল না জীবনটায়...এই
শহরটাকে এতটা অপরিচিত কিউবিকল সর্বস্বও মনে হত না। এখন তার কাছে বড়সর মাপের একটা
চাকরী আছে। পরিচিতের পরিধি টা অনেক বেরেছে কিন্তু বন্ধুর সংখ্যা ক্রম হ্রাস্যমান। তাদের
কেউ কেউ চলে গেছে গুড়্গাওন, কেউ মুম্বাই...কেউ বা সুদূর বিদেশ। কেউ কেউ হয়তো আছে
এখনও এই শহরে কিন্তু সবাই প্রচন্ড ব্যস্ত।
খবরে কাগজে কলকাতার সম্বন্ধে মাঝেই যারা ভিক্টোরিয়ার ছবি লাগিয়ে এক্তা আদ্যন্ত
কর্ম বিমুখ শহরের ছবি তৈরি করেয় তাদের সাথে দেখা করা অনিন্দ্যর মাঝে মাঝে এই
ডেডলাইন মুখর দ্বীপের একটা গাইডেড ট্যুর দিতে ইচ্ছে করে।
মেয়ে দুটো উঠবে উঠবে করছে। ঘড়ির দিকে তাকালো অনিন্দ্য। ঈশ! আজ অনেক দেরী হয়ে
গেল। প্রত্যেকদিনের আধন্টার অবসর কখন যে দেড় ঘন্টা অতিক্রম করেছে খেয়াল ই নেই তার।
মেয়ে দুটো বেশ। রোজকার আশেপাশের টেবিলের প্রোমোশন, বসের গসিপ এর থেকে একটা
অন্যরকম আলোচোনা উপহার দিল তাকে। অনিন্দ্য কুবি নয়।।নয়ত কিছু লিখতো হয়ত। একবার
ভাব্ল আলাপ করবে ওদের সাথে।।কিন্তু পর মুহূর্তেই ভাবল কি বলবে তারপর? তাদের কথায়
আড়িপাততে প্রায় মাঝবয়সি অনিন্দ্য রায়ের ভাল লেগেছে?
মাঝখান থেকে তার অফিসের লাগোয়া কফিশপ টায় যাওয়াই বন্ধ করে দিল সে। বেশী
মেলামেশাও। এখন এখানে আসে সে। বেশী দূরে না, আবার কাছেও না। হাটাপথে মিনিট দশেক।
প্রত্যেকদিনের আধঘন্টার অবসর।
বিলটা মিটিয়ে বেড়িয়ে গেল অনিন্দ্য। অতিলোভ করে সোম থেকে শুক্রর এই আধঘন্টা টা হারাতে
পারবে না সে। এই একঘেয়েমি, কর্মব্যস্ততার শহরে তো একেবারেই না।
২
“দেখো এই বাড়ির মেনটেনেন্সের যা খরচ তা আমাদের পক্ষে চালানো অসম্ভব বৌদি।
বেকার সেন্টিমেন্টাল না হয়ে আমার প্রস্তাব টা ভেবে দেখো। আমাদের বাড়ির দারুন
লোকেশন টা দেখেই কিন্তু মিঃ মুরারকা বাজার চলতি দরের থেকে অনেকটায় বেশী অফার
দিচ্ছেন।”
একনাগারে নিজের কৌশিকের কথাগুল শুনছিল কাজরী। দেশপ্রিয় পার্কের বাসিন্দা, এই
একদা বিত্তবান সেনগুপ্ত পরিবারের বধূ হয়ে যখন কাজরীর এই বাড়িতে প্রবেশ তখন কৌশিক
সদ্য কলেজে ঢকেছে। মনে আছে ওর বিয়েটা কায়স্থ বাড়ির মেয়ে পরমার সাথে ঠিক করার পেছনে
কাজরীর ভূমিকা অনেকটাই।
আর আজ সেই কৌশিক ই কিনা একেবারে গারজিয়ানের ঢঙে তাকে আদেশ করছে এই বাড়িটা
বিক্রি করে দিতে সম্মত হতে। আদেশ ঠিক নয়, তবে হ্যা, যবে থেকে তার বৈধব্য সত্ত্বা
তাকে গ্রাস করেছে, সে লক্ষ্য করেছে এ বাড়ির সবাই তার সব সিদ্ধান্তে নিজেদের
অগ্রাধিকার দেখাতে চেয়েছে। তা সে তার মেয়ে টুয়া কি নিয়ে পড়বেই হোক বা তার নিজের
কতটা অর্থসাহায্য চাই তা নিয়েই হোক।
টুয়ার বাবা মারা যাওয়ার পর কাজরীর পাশে সবাই এসে দাড়াতে চেয়েছিল। একদিক দিয়ে
তো ভালই। সবাই বলল “বাবা! আজকাল কার দিনেও এরকম দেখা যায় নাকি?”। কাজরীর তো খুশী
হওারি কথা।
কিন্তু কোথাও যেন তার এই মহানুভবতার পেছনে একটা করুনার গন্ধ লেগেছিল। সারাজীবন
যা প্রত্যাখান করে এসেছে কাজরী। সেইবার সবার সামনে একবার বলেছিল যে সে একটা চাকরীর
চেষ্টা করবে ভাবছে...ওমনি সবাই রে রে করে উঠেছিল। ছোট ননদ বুকাই তো বলেই ফেলল- “ছি!
বৌদি, এরকম বলতে পারলে তুমি? আমরা কি তোমার পর?”
“বৌদি ভেবে দেখ কিন্তু কথাটা”
কৌশিকের কথায় আবার সম্বিত ফিরল কাজরীর।
“হ্যা, ভাবছি।।কবের মধ্যে জানাতে হবে বললে?”
“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব” চাটা শেষ করচে করচে বলল কৌশিক “আসলে ডিলটা এত ভাল পাচ্ছি,
বুঝতেই পারছো তো। ভয় লাগছে যে দেরি হয়ে গেলে হাতছাড়া না হয়ে জায়”
“হ্যা সে তো ঠিকি। আসলে তোমায় সেদিন ও তো বললাম না...তোমার দাদার এত স্মৃতি এই
বাড়িতে...তাই ঠিক...” আমতা আমতা করে বলল আবার কাজরী।
“আহ! দাদার স্মৃতি কি একার তোমার বৌদি? এ বাড়িতে আমার শৈশব কেটেছে। বাবা মার
স্মৃতি আছে...এই পাড়া...এখানে ডাংগুলি খেলেয় বড় হলাম...।সেই বাড়ি ভেঙে একটা বাহারি শপিং মল হয়ে যাবে, আমাদের ঠাকুরদালান কৌলিন্য হারিয়ে সবার কাছে আরেকটা বিনোদনের
জায়গা হয়ে যাবে, সেটা কি আমার ভাল লাগছে বৌদি? তবে একগুয়ে হয়ে তো লাভ নেই......এই
বাড়ির খরচ বা মেনটেন করা আমাদের আর পোশাবে না। যা দিনকাল দাড়াচ্ছে, আমাদের
কতটুকুনি বা পুঁজি বলোতো?”
“হু!”
“তাছাড়া, এমন কিছু বাজে হচ্ছে না... গড়িয়ার কাছে মিঃ মুরারকার যে নতুন আবাসন
তৈরি হচ্ছে তাতে নতুন ফ্ল্যাট, আর বেশ অনেক টাই টাকা। তোমারো তো ভবিষ্যৎ আছে একটা
বৌদি...টুয়ার বিয়ে আছে...আর আমরা তো কাছেই থাকব সবাই। একি কমপ্লেক্সে। একদম ঝা চক
চকে সবকিছু। আজকাল যেরকম হয় সব। আমাই একদিন দেখে এসেছি...ইয়া বড় বড় ৬ টা টাওয়ার।
দেখবে টুয়ার দারুন লাগবে।”
“হ্যা...তবে গড়িয়া এখান থেকে বেশি দূর হয়ে যাবে না?”
“আরে গড়িয়া তো এখন শহরের মধ্যেই বলে... আমরাই যা ভাবি এরকম। টুয়া র ও কলেজ
কাছে হয়ে যাবে অনেক। বেশী ভেবো না আর...আমি পরশূ আসব আবার ফাইনাল শুনতে। টুয়ার
সাথে কথা বলে রেখোখন।”
বেরোবে বলে তৈরি হল কৌশিক।
“আচ্ছা, আমরা ছাড়াও তো আর বাকি অংশিদার আছে তাদের কি মতামত?”
“আরে সবাই রাজি...এতোভাল অফার টা...নন্তুদারা তো ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আমায়
পাওয়ার অফ এটর্নি দিয়ে দিয়েছে। ওরা কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাট টা নিয়ে খুবি খুশি। নন্তুদা
না কি এরমি একটা প্রোপার্টি তে ইনভেস্ট করতে চাইছিল। আর বাকি বোনেরাও যা ক্যাশ
পাচ্ছে তাতেয় খুশি।”
“ওঃ তাই...ভালো তো”
“হু! ডিল টা হয়ে জাক...তুমিও আমায় ধন্যবাদ দেবে দেখো...আসি তাহলে...পরশু
ফাইনাল করে রেখ সবকিছু...তুমি হ্যা বলার পর রাজ্যের কাজ আছে।।জমি বাড়ির ব্যাপার তো”
কৌশিক চলে যাওয়ার পর তার অংশের সুদর দরজাটা বন্ধ করে দিল কাজরী। টুয়া কলাজ
থেকে ফিরতে এখন অনেক দেরী। এখন তার অখন্ড অবসর। অনান্য দিন এই সময় টুকুর দিকে মুখিয়ে
থাকে কাজরী। গান শোনে। শখের কবিতা লেখে, বই পড়ে। টুয়ার বাবার স্মৃতি চারনা করে
মাঝে মাঝে হয়ত।।কিন্তু আজকাল খুবি কম হয় সেগুলও।।হয়ত অভ্যেস। টুয়ার যখন চার বছর
বয়শ তখন হারিয়েছে মানুষ টাকে। আজ টুয়াও নয় নয় করে ২০ তে পা দিয়েছে প্রায় সাড়ে চার
মাস।
কিন্তু কি আশ্ছরজ আজ তার আর কিছু ভাল লাগছে না...সমানে টানছে ওই সামনের গাড়ি
বারান্দাটা। কি জানি কি পিছুটান থেকে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো কাজরী। আর মুহূর্তে তের
বয়শ কমেয় গেল প্রায় ২২ টা বছর। জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত বিধ্বস্ত এক প্রৌড়া কাজরী
নয়...সে তখন সদ্য একুশের পরশ মাখে লাল শাড়ি আর শাখা পলার সাজে মায়াবি এক কাজরী।
তখন এ বাড়িটায় এক্সাথেয় হাড়ি চরতো প্রায় ৪০ জন লোকের। সদ্যবিবাহিতরা আজ যে স্পেস
পেয়ে অভ্যস্ত, তার কিছুই ছিল না তাদের জীবনে। রাত ১১ টা পর্যন্ত তাদের শোবার ঘরে
তখন আসর জমাতো একপাল ননদ দেওর রা।
কিন্তু ভাগ্যিস ছিল না...নয়ত কি আর ২২ বছর পর এক দুপুরে তার মনে পড়তো যে এই
গাড়ি বারান্দা তে বসেই একদিন মাঝরাতে তাকে তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম আদরের
আশ্লেষে জড়িয়ে ধরেছিল ধ্রিতিমান...স্মৃতির চিলেকোঠায় যার নাম কাজরীর জীবনে টুয়ার
বাবা হিসেবেই থেকে গেছে।
বাড়িটা হয়ত ভেঙে জাবে...অন্যসবাইয়ের মতো কাজরীর ও হয়ত মেনে নেওয়া ছাড়া রাস্তা
থাকবে না..কিন্ত এই স্মৃতির অবসর টুকু কি তার গড়িয়ায় তৈরি হওয়া দু কামড়ার ফ্ল্যাট
দিতে পারবে?