Sunday, January 12, 2014

পিএনপিসি- পর্ব ১

পিএনপিসি- পর্ব ১

বাঙালির অতি প্রিয় টাইমপাস। সেখানে কে কার মাসি আর কে কার পিসি। বলতে গেলে শাহরুখ আর পিসি র প্রেম কাহিনীর হাল হকিকত নির্ভুল ভাবে পঞ্জিকামতে আপনাকে জানাতে পারে একমাত্র পিএনপিসি। স্থান, কাল, পাত্র বিবেচ্য নয়। সঙ্গে ফুলুরি আর মুড়ি হলে মন্দ হয়না। আর চা। সাথে টায়ের ব্যাবস্থায় লুচি ছোলার ডাল থাকলে ব্যাপারটা জমে বেশ।
আমার ব্লগে অবশ্য আমি আগে বিস্তর পিএনপিসি করেছি। সে আবার নতুন কি? বাঙালি লিখছে এদিকে কাদা ছোঁড়াছুড়ি নেই এ আবার হতে পারে নাকি? ওরে পাগল আমরা হচ্ছি কাঁকড়ার জাত। প্রথম বর্ষে একটা দুর্গা পূজো তো পঞ্চম বার্ষিকীতে এক থেকে দুই হলাম আর সেই উপলক্ষে দুই মহলে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হলেও, কার ছেলে মাধ্যমিকে কটা লেটার পেল আর কার ছেলে সাতটা স্যারের নোটস পড়েও হেব্বি ধ্যাড়াল সেই নিয়ে কথার আদানপ্রদান চলতে থাকতেই পারে। কিন্তু আমার মোদ্দা কথা হল পিএনপিসি একটা আর্ট।
 (Image Courtesy: http://memegenerator.net/instance/43425634 )

এই যেমন ধরুন ছোটবেলায় আপনারা প্রত্যেকেই হয়তো দল বেঁধে বেড়াতে গেছেন। আমিও গেছি। বেশ মনে আছে একবার বাবার অফিসের বন্ধুরা এবং তাদের পরিবার- সবাই মিলে এক ট্যুর পার্টির সাথে ঘুরতে গেছি উত্তর ভারতের বিখ্যাত এক পাহাড়ি এলাকায়। জায়গাটা বেশ ভালো। সঙ্গে প্রায় ৫০ জন বাঙালি, ঘোরার থেকে আড্ডা যে কোনো অংশে কম হচ্ছিল না বলা বাহুল্য। বাবার অফিসের কাকুদের এবং কাকিমাদের মোটামুটি চিনতাম। কয়েকজনের ছেলেমেয়ে আবার আমারি বয়সি। সেই সূত্রে আমাদের “বড়রা আমাদের গল্পে নিল না তো বয়েই গেল” একটা হট্টোগোল শুরু হয়েছে। এখানে বলে রাখি আমি তখন ক্লাস নাইন। আন্দাজ করতে পারছেন হাবভাব টা সবজান্তা ধরনের। তা এই ট্যুর পার্টিতে আমরা মানে বাবার অফিসের বন্ধুবান্ধব ও তাদের পরিবারবর্গ ছাড়াও আরও কয়েকজন ছিলেন। এবং অবশ্যই পিএনপিসির মূল আকর্ষণ তারাই হয়ে উঠলেন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলে না দলাদলিতে বাঙালিদের আগে কেউ নেই।
আমরা সংখ্যাগুরু তাই আমাদের কথাই যে সবসময় তামিল হবে তা আমরা প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম। রাতে আমাদের খাবারে যদি চিলি চিকেন আর ফ্রাইড রাইয়স চাই তো তাই হবে। ধন্যি বটে বাঙালি, বেড়াতে গিয়েও ওই চাইনিজ খেয়ে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে এন্টাসিড খাওয়া যায় তা আমি বাঙালি না হলে জানতেই পারতাম না। কিন্তু বাদ সাধলেন একজন।
বেশ চলছিল বেরানো, আপেল বাগান থেকে আপেল পেড়ে খাওয়া। কিন্তু সেই রাত্তিরে প্রায় বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রমহিলা, প্রায় মাতঙ্গিনী স্বরে জানিয়ে দিলেন- “অনেক হয়েছে বাপু ওই দলের তোষামোদ। আমি ওই অম্বলের ডিপো খাবো না। আমার পাতলা মাছের ঝোল চাই”।
বেশ হয়ে গেল। মাথায় অল্প টাক কাকু বললেন- “ইশ! বেরানোর মজাটাইমাটি করে দিল রে। কচি খুকি যেন, আসার আগে মেনুটা দেখেননি নাকি।।লেখা ছিল তো একদিন চাইনিজ”।
সুন্দর গান করেন কাকিমা বললেন- “ইশ! বাচ্চাগুলোর মুখগুলো শুকিয়ে গেছে গো”।
যাই হোক সে রাত্তির কোন মতে রক্ষা হলো। মাসিমা খেয়েছিলেন কিনা জানিনা। পরের দিন সকালে বাসে করে সবাই যাচ্ছি কাছের একটা লেক ঘুরতে। প্রথম বোমাটা পড়লো বাসের মধ্যে। আগেরদিন রাতের ঘটনা নিয়ে তখনো বাজার গরম।
সুন্দর সেলাই করেন কাকিমা আচমকাই গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন- “বুঝলে, রাতুলা, আমাদের ঘর তো ওই মাসিমার ঘরের পাশের ঘরটাই...কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি জানো”।
রাতুলা কাকিমা কথাটা আদিরসাত্মক কিনা বুঝে ওঠার আগি সেলাই কাকিমা বললেন- “কি জোরে নাক ডাকে জানোনা। মেয়েমানুষ যে অতো জোরে নাক ডাকতে পারে জানতাম না বাবা”
“এয়, বল কি?”
“আর কি বলব...সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না...মনে হচ্ছিল ঘরের দেওয়াল যেন ভেঙে পড়বে। সে কি আওয়াজ কি বলব”।
গন্তব্যস্থলে না পৌছলে হয়ত আলোচনা চলতো কিছুক্ষণ, কিন্তু সে যাত্রা থামতে হল। আমার বাবা তখন আমায় একটা কোডাকের ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। সেটা নিয়েই হাত পাকাচ্ছি। কাছেদূরে বেশ গাছগাছালি আছে। দূর থেকে একটা ছবি নেব বলে একটু এগিয়েছি, ওমনি দেখি একটা জটলা।
“এই সত্যি সত্যি হাতির মতো ডাকেরে?”
“আর নয়তো বলছি কি? ওরম আওয়াজ যে কারো নাক ডাকার হোতে পারে ভাবতেই পারিনি”।
ছড়া কাটতে পারেন এক কাকু বললেন “তাহলে তো ওনাকে নাম দেওয়া যেতেই পারে ‘নাকডাকা মাসিমা’”।
একটু রাশভারী জেঠিমা বললেন- “কি দেমাক দেখেছো ভদ্রমহিলার। কেমন করে বলেন কাল”
ফুট কেটে ছড়াকাকু বললেন- “বললে হবে বৌদি। এই বয়সে একা একা ঘুরতে এসেছেন। চেহারাটাতেও বেশ আভিজাত্যের ছাপ আছে কিন্তু”
“আরে রাখো তো আভিজাত্য। থাকে তো মফস্বলে। কি যেন বোড়াল না কি নাম। কিসের এতো অহঙ্কার শুনি”
“একা একা ঘুরতে এসেছে...এদিকে মাছ খায়...সধবা নিশ্চই” রাতুলা কাকিমা ভেবে বের করলেন।
কে যেন বলল- “হ্যা, শাঁখা পলাও তো আছে হাতে”
“তার মানে দেখো গিয়ে বরের সাথে মিল হয়না”
“যা ঝগরুটে, হবে কি করে” রাশভারি জেঠিমা যে বেজায় খচেছেন বোঝাই গেল।
“যাই বলো। হেভি মালদার কিন্তু” আবার ও সেলাই কাকিমার অবদান চোখে পড়ল।
“কি করে জানলি?”
“আরে, আমায় বলছিল সেদিন...ছেলে আছে ওনার একটা। স্টেটসে থাকে...আমার বোনের জন্য ভাবছিলাম আর কি”
“এই আর কি জানিস বলনা”
“এই যে ওখানেই সেটলড...উনিও নাকি ওখানেই থাকেন বছরের অর্ধেক সময়। এখানে এসে হেচে কেশে প্রান যায় আর কি”
“ওই জন্যই অতো দেমাক...হঠাত করে পয়সা হাতে এলে যা হয়” বলে উঠলেন ভবানীপুরের রাশভারী জেথিমা। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো মনে হলো। বুকুন দাদা দিক আমাদের দলে খাপ খায়না। আবার বাবাদের দলেও না। বাবা মা র সাথে ঘুরতে এসেছে কিন্তু সারাটাদিন যে বেজায় বোর হচ্ছে আমরাও বুঝি। পড়াশুনোর পাট চুকেছে প্রায় ২ বছর। ভালই ছিল পড়াশুনোয় শুনেছি...কিন্তু এখনো চাকরীবাকরী জোটেনি কোন।
“সেরকম কেন বলছেন...ছেলেটা কেরকম জানতেই তো জিজ্ঞাসা করছিলাম”
“সাবধান...কি না কি কাজ করে দেখো গিয়ে...বিদেশের নামেই কাটে”
“তা দিদি, কিছু না করার থেকে তো ভালো”
ছড়াকাকু সম্ভাব্য মনোমালিন্য কাটাতে বললেন- “তা বরের ব্যাপারে কিছু বলেনি?”
বেশ! এক মুহূর্তে পরিবেশ আবার হালকা হয়ে গেল।
“না... দাঁড়াও তো এটা তো জানতে হবে”
“হাইলি সাসপিশাস কিন্তু” গোয়েন্দা সুর বলল ছড়াকাকু।
“আরে তোমাদের পাল দা কিছু জিজ্ঞেসই করতে দেয়না”
“এই এটা খুব খারাপ করো কিন্তু পাল দা”- হঠাত যোগ দিলেন মাউথওরগ্যান কাকু। এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন।
“হ্যা, বেশ ভালোই রসদ যোগাচ্ছে তোমাদের” হইহই করে হাসির রোল উঠল।
“যাই বল, ওই নাক ডাকার ব্যাপারটা কিন্তু দারুণ” খিলখিলিয়ে বললেন গানকরা কাকিমা “আমার শুনতে ইচ্ছে করছে খুব।...শুনলে হয় কিন্তু আজকে রাত্রে”
“চলো একটা প্ল্যান করা যাক।" একটা বেশ হট্টোগোল শুরু হলো।
ফেরার সময় হয়ে এসেছিল বোধহয়। নাকি অন্য স্পটে বেড়াতে যাওয়ার। মনে নেই ঠিক এখন আর। রাতের বেলা প্ল্যান টা হয়েছিল কিনা সেটাও এখন আর খেয়াল নেই। হলেও আমাদের দুধভাত বলে বাদ দেওয়া হয়েছিল মনে হয়।
তবে এটুকুনি স্পষ্ট মনে আছে বাকি দুদিন, বা বলা ভালো তৃতীয় দিন আমাদের ট্রেন হাওড়া স্টেষনে ঢোকা অবধি “নাক ডাকা মাসিমা” ছিলেন আমাদের পুরো গ্রুপের মোস্ট টকড এবাউট বিষয়। আমরাও বেশ রাত্তিরে ট্রেনে বসে উনি কেরকম জোরে নাক ডাকেন তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। 
এখন ভাবি আর বলি...ভাগ্যিস তখন ফেসবুক ছিল না। থাকলে যে কি হতো! বেচারা মাসিমা একটাই ভুল করেছিলেন। তার যে কি খেসারত দিলেন। আবার একদিক দিয়ে ঠিক ও ছিল। ফ্রাইড রাইস আর চিলিচিকেন নিয়ে কথা। সাহস ভাবুন একবার।
তবে লেখাটা যদি পড়ে যদি ভেবে বসেন বাঙালিরা শুধুই বেড়াতে গিয়ে, খুশির মেজাজে পিএনপিসি করে তাহলে সে গুঁড়ে বালি। চোখ রাখুন। পড়তে থাকুন J

(ওই দেখো ভেবেই নিয়েছে এই গাঁজাখুরি গপ্পো গুলো কেউ পড়ে!) 

2 comments:

  1. PNPC জিন্দাবাদ! :) কোনও কথা হবে না, দারূণ লিখেছেন :)
    নাক-ডাকা মাসিমা পুরো হিট :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ :) ভালো লেগেছে শুনে খুব ভালো লাগলো।

      Delete

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...